ছেলেটা

রাত ১০:১৫ বাজে।
সোডিয়াম লাইটের ফিকে আলোয় রাস্তার ভিড়ের ভেতর ছেলেটা হাঁটছে একা। চারপাশে শত শত ব্যস্ত মানুষ—কেউ গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে, কেউ আবার ধাক্কাও দিচ্ছে। বাস-ট্রাক গুলো সাই সাই করে পাশ কেটে যাচ্ছে। জীবনের দৌড়ে সবাই যেন ছুটে চলেছে, কারোরই এক মুহূর্ত সময় নেই থামার। শুধু ছেলেটার জীবনটাই যেন থমকে আছে।
রাস্তার চারিপাশ দেখতে দেখতে সে এগিয়ে যায়। সে সবকিছুই দেখছে কিন্তু কোন কিছু খেয়াল করছে বলে মনে হচ্ছে না। হঠাৎ করে ছেলেটা টের পায়—মানুষের কোলাহল, গাড়ির হর্ন সবকিছুই থেমে গেছে, কিছুই যেন আর তার মাথায় ঢুকছে না। সব মিলিয়ে হঠাৎ যেন একরাশ নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। বিস্ময়ে চারপাশে তাকায় ছেলেটা। সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে, চোখগুলোও জ্বালা করতে শুরু করেছে। সে জানে, কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড মাথা ব্যথা শুরু হবে। ফুটপাথেই বসে পড়ে সে। অপেক্ষা করে—ব্যথা কখন শুরু হবে। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, এখনও ব্যথা শুরু হচ্ছে না কেন? এতো দেরী হওয়ারতো কথা না!
ঠিক তখনই, এক পিচ্চি মেয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে মায়ের হাত ধরে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী চোখে তাকায় ছেলেটার দিকে। ছেলেটা টের পেয়ে হেসে ফেলে—একটা নিরীহ, অমায়িক হাসি। তারপর কি মনে করে হঠাৎ ভেংচিও কাটে। পিচ্চিটার মুখ হাঁ হয়ে যায়, মনে হয় এখনই কেঁদে দেবে। কিন্তু তার আগেই মা বিরক্ত মুখে টেনে নিয়ে যায় তাকে।
ছেলেটা পিচ্চি মেয়েটির মুখভঙ্গি মনে করে প্রাণখুলে হেসে ওঠে। হাসতেই থাকে, যেন তার হাসির শব্দে ব্যথার আগমন বিলম্বিত হয় আরও খানিকটা।
* * * * *
সকালে উঠে ছেলেটা ফ্রেশ মনে ইউনিভার্সিটি যায়। কিন্তু পরিচিত মানুষগুলো যখন হাত মেলাতে আসে, সে টের পায়—অনেকের নামই সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। বড়ই আজিব লাগে ছেলেটার। মনে হচ্ছে, নিউরন নিউরনে যে কানেকশন হয়, সেই সিনাপসিস গুলো একেবারে লুজ হয়ে গেছে। বড়ই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় ছেলেটা।
ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের আড্ডায় বসে আছে সে। স্বভাবসত ১০ টাকার মাল্টা চায়ে চুমুক দিচ্ছে, আর সবার সব কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে। সবাই যার যার জীবন নিয়ে গল্প করছে—আদরের নাকি সামনের মাসে বাসা ছাড়তে হবে, বাড়িওয়ালাটা বড়ই জ্বালাতন করছে; আসিফের নাকি এবার ফিজিক্সে এ-প্লাস ছুটে যাবে; সৌমিকের দ্বিতীয় গার্লফ্রেন্ড অভিমান করে গত দুইদিন ধরে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে; আর হামীমের গার্লফ্রেন্ডটা নাকি রাতে এত বকবক করে, তাকে ঘুমাতেই দেয় না। সবকিছুই ইন্টারেষ্টিং লাগে, ছেলেটা তাই মনোযোগ দিয়ে সব শুনছে, কিন্তু হঠাৎ সব নিস্তব্ধ হয়ে আসে। মনে হয়, মাথায় আর কিছু ঢুকছে না তার। বন্ধুরা হাসছে, সেও হাসছে—যেন প্রোগ্রাম করা এক রোবট। সবুজ সুইচ চাপলেই হাসি শুরু করবে, লাল সুইচ চাপলেই বন্ধ হয়ে যাবে।
স্বভাবসত বন্ধুদের পড়াশোনায় সাহায্য করতে গিয়ে দেখে আরেক মহা যন্ত্রণা। সবকিছু কেমন হিজিবিজি হিজিবিজি লাগছে! পরিচিত ইকুয়েশন গুলো সব অপরিচিত মনে হচ্ছে। নিজের পড়াশোনাতেও একই দশা—সহজ বিষয় মাথায় ঢুকছে না। ছেলেটা ভাবছে, এ তো দেখি একেবারে বেতালা অবস্থা!
চিন্তাযুক্ত মনে ক্লাসে ঢোকে সে। অ্যালগরিদম ক্লাস চলছে। মনোযোগ দেয়ার সর্বোচ্চ যুদ্ধ করে যাচ্ছে, জিতবে কিনা বুঝতে পারছে না। স্যার বোঝাচ্ছেন—কীভাবে ম্যাক্সিমাম ফ্লো পাস করা যায় ফ্লো নেটওয়ার্ক দিয়ে। হঠাৎ তার মাথায় অন্য ভাবনা আসে—আচ্ছা আমরাও তো লাইফের প্রতিটা ক্ষেত্রে ম্যাক্সিমাম হ্যাপিনেস পেতে চাই। এই অ্যালগরিদমটা লাইফে কাজে লাগানো যায় না? এরকম একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কেন এখনও কোনো গবেষণা হচ্ছে না, বড়ই চিন্তার বিষয়! ছেলেটা চিন্তার গভীর সমুদ্রে ডুবে যায়। কিছুক্ষণ পর হুশ ফেরে—খেয়াল করে দেখে স্যারের পড়ানো শেষ। এখন স্যার অ্যাটেনড্যান্স নিচ্ছেন!
অ্যালগরিদম ক্লাসের চেয়ে অন্য ক্লাসের অবস্থা আরো বেগৈতিক। হিস্ট্রি ক্লাসে স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছেন, “মেডিইভাল পিরিয়ড অফ বেঙ্গল হচ্ছে সুলতান আর মোঘলদের……”। ছেলেটা একদম শেষে বসে শুনছে। হঠাৎ কি হলো কে জানে, ছেলেটা স্যারের কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছে নাহ্! চারপাশে তাকাল—সবকিছুই ঝাপসা দেখছে, চোখদুটোও বড় জ্বালা করছে। মাথার ভেতর কেউ যেন বিটবক্সিং করছে। এবার সাথে সাথেই প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। যাক এবার দেরী হয়নি, এটা ভালো লক্ষণ! সহজে প্রেডিক্ট করা যাবে তাহলে!
ঘুম পাচ্ছে খুব, কিন্তু ঘুমাতে পারছে না। হাজারটা চিন্তা এসে মাথা এলোমেলো করে দিয়েছে। ছেলেটা গভীর ভাবনায় ডুবে যায়। সে বুঝতে পারছে, সামনে বড় কোন ঝড় আসছে, কিন্তু কখন তা হবে, সে জানে না।
হঠাৎ মনে হলো—লাইফের ঝড়গুলোরও যদি আগাম সংকেত পাওয়া যেত! তাহলে কতই না ভালো হত। আবহাওয়া রিপোর্টের মত লাইফ ফরকাস্টে ঘোষণা আসতো,
“প্রিয় দেশবাসী,
জীবনের এই সন্ধিক্ষণে সবকিছু ওলট-পালট করে দিতে ঘূর্ণিঝড় বাদল ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসছে। ইতিমধ্যেই জীবনের উপকূলে ৯ নাম্বার বিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে।
যাদের জীবনের প্রতি এখনো সামান্য মায়া আছে, বা যাদের বুকের ভেতর একটু আশার বাতি টিমটিম করে এখনো জ্বলছে—তাদেরকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। আর যাদের জীবনে অনেক দূর যাওয়ার ইচ্ছে, তারা অনতিবিলম্বে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করুন। আর যারা ভাবছেন—এইরকম ঝড় জীবনে বহুত সামলেছি—তারা থাকুন যেখানে আছেন, বাকি মারাটা ঝড়ই দিয়ে দিবে।
পরিশেষে, লাইফ ফরকাস্ট বিভাগ থেকে আবারো স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে—প্রেমে পড়া অবস্থায় রেইনকোট কোনো কাজে আসবে না!”
ছেলেটা মনস্থির করে ফেলে, যদি কোনোদিন সত্যিই সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে দেখা মেলে, একবার হলেও অনুরোধ করবে যেন জীবনের জন্যও এমন আগাম বিপদ সংকেত চালু করা হয়! কিন্তু বাস্তবতা বলে, যে পরিস্থিতিতে সে আছে, সেখানে সৃষ্টিকর্তার দেখা মিলবে কি না জানা নেই—তবে শয়তানের সঙ্গে হঠাৎ ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট প্রবল।
* * * * *
রাত ৮টা। লোকাল বাসে করে ফেরার পথে রাস্তার জ্যামে ছেলেটা একমনে মানুষ দেখছে। কিভাবে এক পিচ্চি বাবাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে হোটেলে, গরম গরম পুরী ভাজা হচ্ছে—সম্ভবত সেটা খাওয়ার জন্যই জোরাজুড়ি করছে। আরেক পাশে এক কাপল ঝালমুড়ি ভাগাভাগি করছে। ছেলেটি হয়তো বেশ ভালো কৌতুক করতে জানে, মেয়েটি ছেলেটির কথায় হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে। রাস্তার অন্য কোনায় দাঁড়িয়ে একটি ভার্সিটির মেয়ে ফুচকা খাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ফুচকা মামা সত্যিই ভালো ফুচকা বানিয়েছে—মেয়েটার ফুচকা মুখে দিতে দিতে স্বাদে বার বার চোখ বন্ধ যাচ্ছে।
রাত যত গভীর হয়, সোডিয়াম লাইটের আলোতে সবাইকে কেমন রহস্যময় মনে হয়। যেন সবকিছুই এক বিশাল অদৃশ্য পর্দায় ঢাকা, আর সবারই যেন একটা গোপন ও কষ্টের গল্প আছে বলার।
হঠাৎ ছেলেটার অসহ্য লাগতে শুরু করে সব। সে নেমে হাঁটতে থাকে। ভাবছে, তার জীবনের ঝড় কখন আসবে। মাঝে মাঝেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। তবু সে হাঁটা থামায় না।
* * * * *
“আজ শুক্রবার, বেলা ৩ ঘটিকা হতে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় এক গর্ধবের মাথার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। তাকে ৯ নাম্বার মহাবিপদ সংকেত দেখানোর পরেও সে কিছুই শুনেনি। যার ফল স্বরূপ, ঝড়ের তাণ্ডবে তার সব আশা ভরসা উড়ে গেছে, আর মাথার তার ছিড়ে বেঁচে থাকার সকল ধরনের বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।।
লাইফ ফরকাস্টের বিশেষ নির্দেশনা:
- আজ ছোটখাটো সমস্যার কারণে মাথা ঘোরার সম্ভাবনা: ৮৮%
- পরিচিত ইকুয়েশন হঠাৎ অপরিচিত মনে হওয়ার সম্ভাবনা: ৮০%
- প্রচণ্ড মাথা ব্যথা এবং নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করার সম্ভাবনা: ৯৫%
- চোখ জ্বালা করা এবং অপ্রত্যাশিত অশ্রু ঝরার সম্ভাবনা: ৯৯%
- হঠাৎ নিজের পিছনে নিজের কষে লাথি মারতে চাওয়ার সম্ভাবনা: ১০০%
সতর্কবার্তা: এই ঝড় কখন থামবে বোঝা যাচ্ছে না। তাই সবাই এই গর্ধবের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন।
পরামর্শ: যারা নিজেদের বিরক্তিকর জীবনকে আরো বিরক্তময় করতে চান না, তারা এই ছেলের খোমা দেখার থেকে পুরোপুরি বিরত থাকুন।”
ছেলেটা ধানমন্ডির লেকের পাড়ে বসে বসে ভাবছে—আহা, যদি আবহাওয়া ফরকাস্টের মতো লাইফ ফরকাস্টও থাকত, হয়তো তার ঝড়ের কথাটাও ঠিক এভাবেই বলত।
অতীতে যখনই ছেলেটা ছোটখাটো ঝড়ের কবলে পড়ত, থ্রি ইডিয়টস মুভির আল ইজ ওয়েল ফর্মুলাটা নিজের মত করে অ্যাপ্লাই করত—অল্পটা শান্ত হতে পারত তখন। কিন্তু আজ, যখন নিজেকে বলল, “আরে ধুর, সব ঠিক হয়ে যাবে”, তখন শান্ত হওয়ার বদলে চোখ জলে ভরে গেল। যতবারই চোখ মুছে বলে, ততবারই চোখ জলে ভরে যায়।
ছেলেটা ভাবছে—কি আজিব! চোখের গঠন তো ছোটবেলা পড়েছি, লেকরিমাল গ্ল্যান্ড না ঘোড়ার ডিমের কোনো অদ্ভুত গ্ল্যান্ড থেকে যেন অশ্রু তৈরি হয়। কিন্তু সেখানে এতো জলতো জমে থাকার কথা না! আশ্চর্য, এ তো দেখছি থামার নাম গন্ধ নেই।
একি বেতালা অবস্থা?!