এপিটাফ

‘বাবা?’
‘হুম?’
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘গেলেই দেখতে পাবে।’
অমিত মুহূর্তের মধ্যে মুখ গম্ভীর করে ফেলল। ছেলেটার এই অদ্ভুত স্বভাবটা আমার কাছে এখনো রহস্য—কথা বললেই মুখ গম্ভীর করে ফেলে, মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত চিন্তার বোঝা ওর কাঁধে চাপানো। আমি চুপ করে গেলাম। জানি, দু’মিনিট না যেতেই আবার ও নিজেই কথা শুরু করবে।
‘তা ঠিক,’ অমিত একটু ভেবে বলল, ‘কিন্তু তুমি আমাকে সাদা পাঞ্জাবি পরালে, নিজেও পরেছ। আমি কিন্তু মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছি আমরা কোথায় যাচ্ছি।’
আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘বাহ! তুমি তো দেখি ফেলুদার মতো চৌকস গোয়েন্দা হয়ে যাচ্ছ। তবে একটা প্রশ্ন আছে—গোয়েন্দারা কি ঘুম থেকে উঠতে এত দেরি করে?’
অমিত গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, ‘উঁহু। আমি আসলে অনেক আগেই উঠে গিয়েছিলাম। জানতাম আজ একটা বিশেষ দিন। কিন্তু ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি এসে ডাকবে।’
এরপর হালকা বিরক্ত স্বরে বলল, ‘বরং তুমিই উঠতে দেরী করেছো।’
ছেলেটার অভিযোগ শুনে আমি খানিকটা হকচকিয়ে গেলাম। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর হওয়ার ভান করলাম।
‘ওহো! তোমার তো বেশ বুদ্ধি হয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় বলো তো, তোমার এই অতি বুদ্ধির জন্যই কি স্কুল থেকে প্রিন্সিপাল মাঝে মাঝেই আমাকে ডেকে পাঠান? গত পরশুও আবার ডাকলেন— শুনেছি, তুমি নাকি কারো সঙ্গে মারামারি করেছো!’
অমিত একদম চুপ হয়ে গেল। চোখ নামিয়ে ফেলল মাটির দিকে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘আমি কি করবো বলো? বল্টুই প্রথমে আমাকে মেরেছে। আমি তো শুধু পরে একটা ঘুসি দিয়েছি।’
আমি আমার ছেলেকে ভালো করেই চিনি। তাই গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘শুধু একটাই ঘুসি?’
অমিত একটু ইতস্তত করে উত্তর দিল, ‘একটা না বাবা…আসলে কয়েকটা দিয়েছি।’
‘কয়েকটা মানে?’
‘কয়েকটা মানে…প্রথমে পেটে কিছু, তারপর পিঠে বাকিগুলো!’
আরো গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘আর কি কি করেছো?’
অমিত ছোট গলায় বলল, ‘ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম।’
এবার ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর?’
ছেলেটা প্রায় ফিসফিস করে উত্তর দিল, ‘তারপর একটা লাথিও মেরেছি। কিন্তু আস্তে মেরেছি, বাবা! ওর শরীর তো গন্ডারের মতো শক্ত—একটুও ব্যথা পায়নি। সত্যি বলছি!’
কথাশুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এখনই ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়া দরকার—খুবই দরকার! কিন্তু এর জন্য আগে রাগ হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে রাগ আসছে না বলে সেটা করাও যাচ্ছে না। বরং ভেতরে ভেতরে একটা অদ্ভুত হাসি পাচ্ছে আমার। ছেলেটা একদিকে অপরাধ স্বীকার করছে, আবার নিজের পাপটাকে হালকা করার জন্য এমন অদ্ভুত যুক্তি দিচ্ছে—“লাথি দিয়েছি, কিন্তু আস্তে!” শুনে হাসবো, নাকি কাঁদবো বুঝতে পারছি না।
আমি শীতল কণ্ঠে বললাম, ‘এতকিছুর পর তুমি একটা লাথিও মেরেছো! শোনো অমিত, আর কক্ষনো এমনটা করবে না। কাল স্কুলে গিয়েই ওকে স্যরি বলবে। ঠিক আছে?’
অমিত মুখ কালো করে মাথা নেড়ে উত্তর দিল, ‘ঠিক আছে। স্যরি বাবা, এমনটা আর কখনো হবে না।’
স্যরি বলছে, আর কখনো করবে না বলছে, কিন্তু আমি ভালো করেই জানি—এই কাজ ও আবার করবে। শুধু তাই নয়, পরের বার কয়টা লাথি মারবে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন কিনা, সন্দেহ আছে।
অমিত মুখ ভার করে বসে আছে। ওর ধবধবে সাদা গোলগাল মুখটা দেখে বড় মায়া লাগছে। ছেলেটা এত সুন্দর হল কিভাবে? দেখতে এত মায়া লাগে যে, বকা দিতে একদম ইচ্ছে করে না। এই শান্ত মায়াবী মুখটা দেখে কে বলবে যে সে এত দুষ্ট হয়েছে।
আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম গলায় বললাম, ‘আর এমন করবে না, ঠিক তো?’
অমিত একটু চুপ থেকে হঠাৎ কঠিন গলায় বলল, ‘তবে বাবা, ও যদি বর্ষাকে আবার জ্বালাতন করে, তাহলে কিন্তু আমি আবার ওকে মারবো।’
আমি ভুরু উঁচু করে বললাম, ‘অবশ্যই না। তুমি তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলবে।’
এরপর মুচকি হেসে বললাম, ‘তা বর্ষাটা কে?’
অমিত একটু যেন লজ্জা পেল। চোখ নামিয়ে ছোট গলায় বলল, ‘বর্ষা আমার খুব ভালো বন্ধু। জানো বাবা, ও না খুব ভালো নাচ যানে।’
বন্ধুর কথা বলতে গিয়ে ওর চোখ কেমন চিকচিক করে উঠল।
‘ও আচ্ছা, তাই’, আমি মুচকি হেসে বললাম।
অমিত তার বন্ধু বর্ষার গল্প বলেই যেতে লাগলো। তার ছোট্ট মুখে অফুরন্ত উচ্ছ্বাস। কিন্তু আমি কেন যেন ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারছি না। মাথা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে আসছে।
আচ্ছা, মীরাও তো দারুণ ক্লাসিক্যাল নাচ জানত। ইউনিভার্সিটিতে ওর নাচের পারফরমেন্স ছাড়া প্রতিটি প্রোগ্রামই যেন অসম্পূর্ণ ছিল। নাচের সঙ্গে ওর মুখভঙ্গি, সেই অদ্ভুত মিষ্টি হাসি, আর বড় বড় চোখ—এসব একসঙ্গে দেখলে মনে হতো মানুষ নয়, যেন আলো দিয়ে গড়া কোনো পরী। সেই অবস্থায় মীরাকে দেখলে যেকোনো ছেলেই তৎক্ষণাৎ মোমের মতো গলে যেত। যেমনটা আমি গলেছিলাম!
আজ কেন জানি, অমিতের মুখে বর্ষার গল্প শুনতে শুনতে মীরার স্মৃতিগুলো হুড়মুড় করে এসে মাথায় ভর করছে। হঠাৎই মনে হলো—আমি যেন আমার স্মৃতির সমুদ্রে অচেনা কোনো ভেলায় ভেসে যাচ্ছি।
* * * * *
পৌষ মাস। বাইরে হিমশীতল হাওয়া বইছে। বাসের ভেতরে মানুষ গাদাগাদি করে বসে আছে। তবু ঠাণ্ডার দমকা হাওয়া জানলার ফাঁক গলে ঢুকছে নির্দ্বিধায়।
ছেলেটা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারিনি। ঠাণ্ডায় মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমি নিজের চাদরটা আলতো করে ওর গায়ে জড়িয়ে দিলাম। অমিত একটু নড়েচড়ে নিয়ে আবার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেল।
বাস চলছে নিজের মতো ব্যস্ত ভঙ্গিতে। কিছুক্ষণ পর গড়গড় শব্দ করে শাহ্বাগের সিগন্যালে থামল। কাঁচের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি—খুচরা বিক্রেতারা পাইকারীদের কাছ থেকে ফুল কিনছে। তর্ক-বিতর্ক, দামাদামি চলছে প্রবল উৎসাহে। এত হট্টগোল দেখে মনে হচ্ছে, জাতীয়সংসদের কোনো অধিবেশনে দেশের বাজেট ঘোষণা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে।
আরেকটু দূরে খুচরা বিক্রেতাদের দোকান থেকে লোকজন গোলাপ বা গাঁদা ফুলের মালা কিনছে। কে জানে, হয়তো প্রিয়জনের মন ভোলানোর জন্য। পাশ দিয়েই এক হকার জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি উদেশ্য করে চিৎকার করছেন, ‘বাসায় শান্তি চাইলে, পাচ টেহার একটা গুলাপ নিয়া যান ভাই।’
ঠিক তখনই অমিতের ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে চারপাশ দেখে সে একেবারে হতবাক। ড্যাবড্যাব করে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে, বোধয় বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে কোথায় আছে। মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো পৃথিবীর বাইরে কোথাও চলে এসেছে!
হঠাৎই ওর ছোট্ট কণ্ঠে প্রশ্ন ভেসে এলো, ‘আচ্ছা বাবা, আজ তো মার জন্মদিন। মার জন্য কিছু কিনবে না?’
আমার বুকটা যেন হালকা কেঁপে উঠল। ছেলেটা তাহলে ভুলে যায়নি! সত্যিই আজ মীরার জন্মদিন। আর আশ্চর্য ব্যাপার—মীরার সঙ্গে আমার প্রথম দেখাটাও হয়েছিল ওর জন্মদিনেই।
তখন বর্ষাকাল। সদ্য এক দফা মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে। মীরা সেদিন আকাশি রঙের শাড়ি পরেছিল, আর কপালে শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে ছোট্ট একটা নীল টিপ। খোলা রেশমী চুলগুলো বাতাসের ঝাপটায় বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। হাতে একগাছা কদম ফুল নিয়ে টিএসসির পথ ধরে বান্ধবীদের সঙ্গে হাঁটছিল। আর মাঝেমধ্যেই খিলখিল করে হেসে উঠছিল। কে জানে, হয়তো বান্ধবীদের গোপন রসিকতায়, অথবা কোনো ছেলের বোকা চাহনিতে।
কিন্তু আমার তখন এত কিছু বোঝার সময় নেই। ততক্ষনে আমি সাত আসমানের উপর ভাসছি। যতবারই ওর দিকে তাকাচ্ছিলাম, ততবারই বুকের ভেতর একটা ধাক্কার মতো লাগছিল। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। এত সুন্দরও কোনো মানুষের হাসি হতে পারে, আগে জানা ছিলো না!
ঠিক তখনই বুঝেছিলাম—আমি পুরোপুরি ফেঁসে গেছি। প্রকৃতি আমাকে অদ্ভুত এক বন্ধনে আটকে ফেলেছে, যে বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার আমার কোন উপায় নেই। আমৃত্যু!
অমিতের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো।
‘বলো না বাবা, মার জন্য কিছু কিনবে না?’
আমি হেসে বললাম, ‘তুমিই বলো, তোমার মার জন্য কী কিনব?’
অমিত ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভেবে গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুমিই না বলো, মার ফুল খুব পছন্দ। চলো তাহলে, মার জন্য ফুল কিনে নিয়ে যাই।’
সত্যিই তো—মীরার টকটকে লাল গোলাপ ভীষণ প্রিয়। টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতাম বিধায় ওকে দামি কিছু দেয়ার সামর্থ্য ছিলনা। মীরাও কখনও কিছু চাইত না। তবু ওর ২১তম জন্মদিনে ২১টা গোলাপ দিয়েছিলাম। মেয়েটা এতেই খুশিতে কেঁদেকেটে একাকার করে ফেলেছিল। এরপর আমরা সারাদিন রিকশা করে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। মীরা সারাক্ষণ আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিল, যেন হাত ছাড়লেই আমি উধাও হয়ে যাব! কত বছরের পুরোনো স্মৃতি, অথচ মনে হয় একেবারে সেদিনের ঘটনা।
এমন সময় সিগন্যাল ছেড়ে দিল। আমি অমিতকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে শাহ্বাগ নেমে গেলাম। ওকে সঙ্গে নিয়ে মীরার জন্য ৩২টা টকটকে লাল গোলাপ কিনলাম।
হঠাৎ অমিত আমার পাঞ্জাবির হাতা ধরে টান দিল। চোখ গোল গোল করে ফুলের দোকানের এক কোণায় আঙুল তাক করে বলল, ‘বাবা বাবা দেখো, কতগুলা কুকুরছানা! কী সুন্দর দেখতে, তাই না?’
আমি তাকিয়ে দেখি—চারটে কুকুরছানা, জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। শীতে কাঁপছে। দেখলেই মন কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায়।
অমিত পরক্ষণেই ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত মুখে বলল, ‘কিন্তু বাবা, ওরা তো ঠাণ্ডায় কাঁপছে। ওদের মা-টা কোথায় গেল?’
আমি উত্তর দিতে পারলাম না। ছেলেটার সহজ প্রশ্নের উত্তরটা আজ কেন যেন খুব কঠিন ঠেকছে। শুধু নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলাম।
অমিত হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলল, ‘ওরা শীতে প্রচণ্ড কাঁপছে। ওদের জন্য কিছু করা যায় না, বাবা?’
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বললাম, ‘না বাবা, তুমি চাইলেও ওদের জন্য কিছু করতে পারবে না। প্রকৃতি কাউকে কাউকে শুধু কষ্ট দিতেই বাঁচিয়ে রাখে।’
অমিত চোখ বড় বড় করে তাকাল। তারপর যথারীতি তার প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসল।
‘প্রকৃতি আসলে কী, বাবা?’
‘তোমার চারপাশের সবকিছু—এই আকাশ, অনন্ত নক্ষত্রবীথি, নদী, পাহাড়—সবকিছু মিলিয়েই প্রকৃতি।’
‘আমরাও কি এই প্রকৃতির অংশ?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে প্রকৃতি আমাদের এত কষ্ট কেন দেয়, বাবা?’
নিজের অজান্তেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। ধীরে বললাম, ‘জানি না বাবা।’
‘কেন জানো না?’
‘কারণ আমিও যে তার উত্তর খুঁজছি।’ পরক্ষণেই হালকা হেসে বললাম, ‘তুমি কিন্তু খুব বেশি প্রশ্ন করো।’
অমিত ভ্রু কুঁচকে তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করল, ‘প্রথমেই যদি ঠিকমতো বুঝিয়ে বলো, তাহলে এত প্রশ্ন করতে হয় নাকি?’
আমি হেসে ফেললাম। ছেলেটা এবার আদেশের সুরে বলল, ‘এখন ওই বাচ্চাগুলোর ঠান্ডা থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করো।’
শেষ পর্যন্ত ছেলেটার জোরাজুরিতে, একটা পুরোনো বস্তা জোগাড় করে কুকুরছানা গুলোকে ঢেকে দিলাম। গরম পেয়ে ওরা গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে কিছু শুকনো খাবারও কিনে রেখে দিলাম। খানিক বাদেই ছানাগুলোর মা কোথা থেকে যেন এসে হাজির হলো।
অমিত ছানাগুলোর মাকে রুটি দিতে দিতে বকছে, ‘শোনো, ওরা ছোট। ওদের ছেড়ে বেশি দূরে যাবে না। আমি এদিকটায় আসলে তোমাদের খাবার দিয়ে যাব, না হলে বাবা এসে খাবার দিয়ে যাবে।’
ছানাগুলোর মা খাবার পেয়ে খুশিতে জোরে জোরে লেজ নাড়ছে। মনে হলো যেন মনোযোগ দিয়ে অমিতের কথাই শুনছে।
আমি নীরবে অমিতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। মনে হলো—ছেলেটার হৃদয়ও তার মায়ের মতোই মায়ায় ভরা। কিছুক্ষণ পর রিকশায় উঠে আবার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
* * * * *
রিকশা ছুটছে টিএসসি-র দিকে। গাড়িগুলো সাই-সাই করে আমাদের রিকশাটাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। হিম বাতাসে হাত-পা কেমন নিথর হয়ে আসছে। বয়স যে বেড়েছে, শরীর সেটা জানান দিচ্ছে। চাঁদরটা আরও ভালোভাবে গায়ে চাপিয়ে দিলাম।
অমিতের দিকে তাকিয়ে দেখি সে বেশ ফুরফুরে আছে। ফুলের প্যাকেটটা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে রেখে, খুব আগ্রহ নিয়ে চারপাশ দেখছে, মাঝে মাঝে ভ্রু কুঁচকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর যথারীতি সে কথা বলতে শুরু করলো। ছেলেটা এত কথা বলা যে কোথায় শিখলো, কে জানে?
‘বাবা, গোলাপের গন্ধ তো একদমই বাজে। মা কেন যে এসব পছন্দ করে?!’
‘আমিও জানি না, বাবা।’
‘আচ্ছা বাবা, তুমি কি মাকে অনেক ভালোবাসো?’
‘হুম।’
ফুলগুলো কোলের উপর রেখে অমিত দুপাশে হাত ছড়িয়ে বলল, ‘কতখানি ভালোবাসো? এত্তখানি?’
মিষ্টি হেসে বললাম, ‘তার থেকেও একটু বেশি।’
অমিত গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু মাকে অতটা ভালোবাসি না।’
‘ছিঃ অমিত। অমন কথা বলতে নেই।’
অমিত কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, ‘স্কুলে আমার সব বন্ধুদের মা-রা নিয়ে যায়। আর আমার বেলা…তুমিও প্রতিদিন নিয়ে যাও না স্কুলে।’
কথা শুনে ছেলেটার জন্য বেশ মায়াই হচ্ছে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম গলায় বললাম, ‘আমি সত্যি স্যরি, বাবা। এরপর থেকে তোমাকে আমি প্রতিদিন স্কুলে পৌঁছে দেব।’
ছেলেটা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল। এর মানে কি বুঝিয়েছে, কে জানে? আমি চুপ করে গেলাম। ছেলেটাকে শুধুই মিথ্যে আশ্বাস দিলাম—জানি, রাখতে পারব না। আমরা সবাই প্রায়শই মিথ্যে আশ্বাস দেই। রাখতে পারব না জানি, তবু দেই। কেন করি এমন? প্রকৃতি কি আমাদের দিয়ে এমন করিয়ে নেয়, পরে বসে বসে মজা দেখে?
হঠাৎ মীরার কথা মনে পড়ে গেল। একবার ওর সঙ্গে দেখা করব কথা দিয়ে দু’_সপ্তাহ দেখা করতে যেতে পারিনি। দু’_সপ্তাহ পর ওর প্রিয় তেঁতুল আর বড়ইয়ের আচার নিয়ে গেলাম দেখা করতে। পৌঁছে দেখি মীরা সবুজ রঙের শাড়ি পরে এসেছে, অস্থির হয়ে পায়চারী করছে। দূর থেকে দেখতে ওকে পরীর মতন লাগছে, সবুজ পরী।
কিন্তু কাছে যাওয়ার পর বুঝলাম, মীরা আমার উপর ভীষণ চটে আছে। আচারগুলো ওর হাতে দিতেই এক ঝটকায় সব আচার ছুড়ে মারল। এরপর সে কি কান্না! রাগে অভিমানে হরবর করে কথা বলছিল, ‘বাহ্, এত দিন পর আমার কথা মনে পড়লো? এত দিন পরে দেখতে এসেছে বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি।’
একটু দম নিয়েই আবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাগ ঝাড়তে শুরু করল, ‘আমি মরে গেলেই তো তোমার শান্তি। যেদিন থাকবোনা আর, সেদিন বুঝবে। তখন রোজ রোজ দেখা করার যন্ত্রণাও আর পোহাতে হবে না।’
কাঁদতে কাঁদতে মীরা সেদিন চোখ-মুখ সব লাল করে ফেলেছিল। বেচারীকে বলার আর সাহস হয়নি, এই কাঁদো মুখেও তাকে এত মিষ্টি লাগছে দেখতে, খুবই আশ্চর্য! এরপর অনেক কষ্টে হাতে-পায়ে ধরে, কানে ধরে উঠবস করে, আইসক্রিম খাইয়ে ওকে শান্ত করতে হয়েছিল। এরপর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রমিস করেছি, এই জীবনে আর কোনোদিন তাকে ভুল আশ্বাস দেব না।
রিকশার হালকা দুলুনির মাঝে, অমিতকে বুকে চেপে ধরে মনে হলো—ছেলেটাও মার মতনই প্রচণ্ড অভিমানী হয়েছে। কি জানি, তাকে দেয়া আজকের আশ্বাস না রাখতে পারলে কি করবে?
* * * * *
আজিমপুর কবরস্থান।
আমি আর অমিত দাঁড়িয়ে আছি মীরার কবরের পাশে। চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল মাঝে মাঝে শুধু শুকনো পাতার মচমচ শব্দ ভেসে আসছে। ধুলোবালিতে আর সময়ের ফেরে এপিটাফের লেখাগুলো মলিন হয়ে এসেছে। তবুও স্পষ্ট বোঝা যায়—
Mira Chowdhury
December 13, 1985 - February 18, 2011
“I am the soft star that shines at night.
Do not stand at my grave and cry.
I am not there; I did not die.”
মেরী এলিজাবেথের কবিতাটা মীরার ভীষণ প্রিয় ছিল। আমি কবিতা খুব একটা বুঝি না, সেজন্য কবিতা তেমন ভালোও লাগে না, তাই মাঝেমাঝে ওকে খেপাতাম—‘তুমি আবৃত্তি শুরু করলেই আমার মাথাব্যথা শুরু হয়।’ মীরা তখন গম্ভীর মুখে বলত, ‘তুমি তো আনরোমান্টিক গাধা একটা। আর্টের কিছুই বোঝো না। কবিতা-গান হচ্ছে আমাদের আত্মশুদ্ধির জন্য।’ আমি ভেতরে ভেতরে হাসতাম। ভাবতাম—আমার আত্মা তাহলে বোধহয় সারাজীবনই অপরিষ্কার থেকে যাবে।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি—মীরার কণ্ঠে কবিতা শুনতে অপূর্ব লাগত। এই কবিতাটা—Do not stand at my grave and weep—ও এতবার আবৃত্তি করেছে যে আমি না চাইতেও মুখস্থ করে ফেলেছি। অথচ স্কুলে পরীক্ষার সময় কবিতা মুখস্থ করা থেকে প্রাণপণে দূরে থাকতাম।
আজ মীরার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ সেই লাইনগুলো নিজের অজান্তেই মুখে চলে এল—
Do not stand at my grave and weep,
I am not there, I do not sleep.
I am a thousand winds that blow;
I am the diamond glints on the snow.
I am the sunlight on ripened grain;
I am the gentle autumn's rain.
When you awaken in the morning's hush,
I am the swift uplifting rush
Of quiet birds in circled flight.
I am the soft star that shines at night.
Do not stand at my grave and cry.
I am not there; I did not die.
অমিতের জন্মের সময় মীরা যখন হাসপাতালে ভর্তি, তখন আমাকে বলেছিল, ‘আমার জন্য পরের বার অবশ্যই জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতার বই নিয়ে এসো।’
আমি পরের দিনই কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম—জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। কিন্তু কী লাভ? ততোক্ষণে বই পড়ার মানুষটাই যে চলে গেছে।
সেদিন আমি একটুও কাঁদিনি। শুধু ছোট্ট অমিতকে আঁকড়ে ধরেছিলাম। কারণ মীরা যে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করেছিলো, ‘আমি যদি আর বাসায় ফিরতে না পারি, তুমি কিন্তু কক্ষনো কেঁদো না।’
আমি কথা রেখেছিলাম। কাঁদিনি। একটুও কাঁদিনি।
কিন্তু আজ, কেন যেন চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে। ধুলোবালির কারণে কিনা কে জানে! ঢাকায় শীতকালে ধুলোবালি এমনিতেই বেশ বেড়ে যায়।
অমিত তার মায়ের কবরের পাশে গোলাপ ফুলগুলো রেখে অঝোরে কাঁদছে। আর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘মা অনেক পচা…অনেক খারাপ। আমাদের একা রেখেই আকাশের তারা হয়ে গেছে। বাবা, মা কি সত্যিই আর ফিরবে না?’
আমি চুপ করে রইলাম। ছেলেটার এই প্রশ্নের উত্তর দেবার সাহস ও শক্তি কোনোটাই আমার অবশিষ্ট নেই।
শীতের এই সকালে কোথা থেকে যেন সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে। চারপাশে উত্তাপহীন আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোতে ছেলেটার অশ্রুগুলো মুক্তোর মত ঝরে পড়ছে। ছেলেটা অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। আমিও আর থামালাম না। কাঁদুক না একটু। মাঝে মাঝে কাঁদা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো—মন হালকা হয়!
পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, দিগন্ত বরাবর একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে। মনে হলো সবকিছু ছিন্ন করে সে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আচ্ছা, তাকে যদি একটা বার্তা দেই, সে কি মীরাকে তা পৌঁছে দেবে? দিবে হয়তোবা।
চোখগুলো আবার ঝাপসা হতে শুরু করেছে। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে নীরবে শুধু বললাম—
‘শুভ জন্মদিন, মীরা।’