তন্ময়কে লেখা খোলা চিঠি

ইস্কুলের সেই পুরনো বন্ধু, তন্ময়। যাকে ইবলিশ দেখলেও হয়তো থমকে যাবে, লজ্জা পাবে—মনে মনে বলবে, “আমার থেকেও বড় শয়তান থাকতে, সবাই আমাকে কেন খারাপ ভাবে, বুঝি না?”
যাই হোক, ২০২০ সালের এপ্রিলের কথা, প্যানডেমিকের লকডাউনের সেই বিষণ্ণ সময়ে বসে ওর উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখেছিলাম। মাঝে অনেক গুলো বছর কেটে গেছে, চিঠিটা আর দেওয়া হয়নি। হয়তো কোনোদিনই দেওয়া হতো না। কিন্তু আজ হঠাৎ এত বছর পর চিঠিটি আবার নজরে পড়ল, আর মনে হলো—গোপনে রেখে দেওয়ার চেয়ে শেয়ার করাটাই ভালো।
তাই আজ সেই চিঠিই এখানে তুলে ধরছি—একটা খোলা চিঠি হিসেবে।
প্রিয় তন্ময়,
কেমন আছো? যদিও তোমার মতো বদ ছেলের খারাপ থাকার প্রশ্নই আসে না, তবুও আজ জানতে ইচ্ছে হলো। কারণ শুনেছি, ইবলিসেরও মাঝে মাঝে শরীর খারাপ হয়। প্যানডেমিকে প্রতিদিনই শত শত মানুষের সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু তোমার মতন শয়তানের যে কিছুই হয়নি—এটা হলফ করে বলতে পারি।
জানো, আজ আমাদের এদিকটায় প্রবল তুফান শুরু হয়েছে। থেমে থেমে দমকা হাওয়া বইছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো কালবৈশাখী ঝড় শুরু হবে। মনে হচ্ছে, একদম বিড়াল এবং কুকুর টাইপ বৃষ্টি হবে। আগে বৃষ্টি হবে দেখলেই আনন্দ হতো, কিন্তু আজ কেন যেন হচ্ছে না; বরং প্রচণ্ড বিষণ্ণ লাগছে। সেজন্য এ মেঘলা দিনে তোমাকে চিঠি লিখতে বসলাম।
আরেকটা অদ্ভুত বিষয় জানো কি? আরো এক জায়গাতেও প্রবল ঝড় চলছে, আমি ঠিক ঠিক অনুভব করতে পারছি। কিন্তু দুঃখটা কি জানো? বাহিরের ঝড় হয়তো কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে যাবে, কিন্তু মনের গহীনে, সেই অন্ধকার ছোট্ট গলিতে হতে থাকা ঝড়—হয়তো কখনই থামার নয়।
আচ্ছা, তোমার কি মনে পড়ে, আমরা আগে কতই না গল্প করতাম? দুনিয়ার হাজার কাহিনী যেন সেসব গল্পে উঠে আসতো। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত—তবু আমাদের অহেতুক সেই গল্প আর খুঁনসুটি কখনো ফুরোত না। মনে পড়ে নিশ্চয়ই তোমার, আমারও পড়ে। কেমন যেন হঠাৎ সবাই বড় হয়ে গেছি, সময়গুলো চলে গেছে চোখের পলকে—বুঝতেই পারিনি! এখনও মনে হয়, সবকিছু…এইতো সেদিনকার কথা।
কিন্তু বড় হওয়া কেমন যেন কষ্টের, তাই না? বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকে চিনচিনে একটা ব্যথা শুরু হয়, আর দিন যতই যায়, ব্যথাটা সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে। তবুও হঠাৎ যখন মনে পড়ে যায় সেসব দিনের কথা, নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে ছোট্ট এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। হয়, তোমার এমন কখনো? হয়তো হয়, হয়তো বা না—সেই তর্কে নাইবা গেলাম।
আজকাল আমার না একটা স্মৃতির কথা খুব করে মনে পড়ছে, আর মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার প্রতি প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। কাছে পেলে হয়তো ধুম করে মেরেই বসতাম! বুঝতে পারছো না, তাই না? ধৈর্য ধরো, বুঝিয়ে বলছি।
কোনো এক সন্ধ্যেবেলা, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে তোমার মস্ত বড় এ বদ মাথায় আইডিয়া আসলো—ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার। সাধারণত এই খেলায় কেউ সত্যি কথা বলে না। কিন্তু তবু তুমি যখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, “সুজিৎ তোমার কি সত্যি কেউ আছে, যাকে তুমি ভালোবাসো? একদম সত্যি করে বলবে!” আমি কিন্তু সেদিন তোমাকে মিথ্যে বলতে পারিনি, সত্যি জবাবই দিয়েছিলাম। তারপর যখন আমি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললাম, “ভালোতো বাসি কিন্তু কখনো বলতে পারিনি মানুষটাকে।” সেদিন তুমি খুব গম্ভীর হয়ে বলেছিলে, “জানিয়ে দিও ভাই তোমার অনুভূতির কথা, কখনো সুযোগ হলে। বলে দিলে হয়তো একবারই মরবে, কিন্তু না বলতে পারলে প্রতিদিন মরবে, একটু একটু করে।” তোমার ওই কাব্যিক কথা শুনে আমি সেদিন ছোট্ট করে হেসেছিলাম। কিন্তু কাকতালীয় ব্যাপার কি জানো? ভেতরে ভেতরে আমি মারা যাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, সত্যিই তো, আমি প্রতিদিনই মরছিলাম একটু একটু করে!
কিন্তু সেদিন তুমি আমার কাছে একটা চরম সত্যি কথা লুকিয়ে ছিলে—সেটাই আমার রাগের কারণ। সেদিন ওই কথার সাথে কেন বলোনি যে, প্রচন্ড সেই ভালোবাসার মানুষটাকেই যখন আর পাশে পাবে না, তখন তুমি শুধু প্রতিদিন নয়, প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে মরবে। হাজার মানুষের ভিড়ে মরবে, রাতের অন্ধকারের একাকিত্বে মরবে, মধ্যরাতে ঝরে পড়া দু’ফোঁটা অশ্রুতে মরবে। ভোরের পাখির কিচিরমিচিরে যেমন করে মরবে, পূর্ণিমার চাঁদের অপরূপ জোছনাতেও তুমি তেমনি করে মরবে। এমনকি বর্ষায় বৃষ্টির প্রতি ফোঁটায় ফোঁটায় মরবে, শীতের কুয়াশাতে মরবে, বসন্তে ফুলের তীব্র ঘ্রানেও মরবে। মরবে তুমি নিঃসন্দেহে, মরতে তোমাকে হবেই! শীতল বাতাসেও দম বন্ধ হয়ে আসবে তোমার, স্মৃতির বিশাল গোলক ধাঁধায় আটকে যাবে জীবন।
কেন বলোনি সেই কথাগুলো সেদিন? কেন লুকিয়েছিলে? বলতে পারতে না আমাকে সেদিন এ কথাগুলো, জানতে না তুমি? তোমার তো জানার কথা ছিল। এতো কিছু জানো, অথচ এসব জানতে না?
আচ্ছা তুমি কি শুনতে পাচ্ছো, তোমার প্রতি এক নিঃস্ব পথিকের ভৎসনা? শুনতে পাচ্ছো কি, পথিকের সেই নিঃশব্দ চিৎকার? জানি, শুনতে পাবে না। প্রচন্ড ঝড়ের রাতে, অন্ধকার গলিতে পথ হারিয়ে ফেলা পথিকের নিঃশব্দ চিৎকার—কেউই শুনতে পায় না, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও না।
ভালো থেকো।
ইতি,
সুজিৎ